হিন্দু দেবতা শিবের অনেক রূপের মধ্যে একটি রূপ মহাকাল
দীপাবলির আগেই নতুন রূপে সাজল উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দির বা মহাকাল মন্দির। প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা খরচ করে বানানো মধ্যপ্রদেশের এই মন্দিরের করিডর প্রকল্পের প্রথম দফার উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশকে উৎসর্গ করা করিডর প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পাশাপাশি মঙ্গলবার মহাকাল মন্দিরে বসে পূজার্চনা করতেও দেখা গিয়েছিল দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু কেন এত বিখ্যাত এই মহাকাল মন্দির? কেনই বা এই মন্দিরকে এত পবিত্র বলে গণ্য করা হয়?
মনে করা হয়, এই জ্যোতির্লিঙ্গগুলিই শিবের সবচেয়ে পবিত্র আধার। পুরাণ মতে, আলোর অন্তহীন স্তম্ভ রূপে শিব সারা বিশ্বকে বেঁধেছিলেন। সেই আলোকস্তম্ভই জ্যোতির্লিঙ্গ নামে পরিচিত।
মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ বাদে, অন্য এগারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে গুজরাটের সোমনাথ মন্দির এবং নাগেশ্বর মন্দিরে, অন্ধ্রপ্রদেশের মল্লিকার্জুন মন্দিরে, মধ্যপ্রদেশের ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে, উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ মন্দিরে, মহারাষ্ট্রের ভীমাশঙ্কর, ত্র্যম্বকেশ্বর এবং ঘৃষ্ণেশ্বর মন্দিরে, উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে বিশ্বনাথ মন্দিরে, ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ মন্দিরে এবং তামিলনাড়ুর রামেশ্বর মন্দিরে।
শিবকেই উজ্জয়িনীতে প্রধান দেবতা হিসাবে পুজো করা হয়। লোককথা অনুযায়ী, শিব এই শহরের রাজা ছিলেন। এই শহরে মহাকালের মন্দির ছাড়াও আরও কিছু বিখ্যাত এবং প্রাচীন মন্দির রয়েছে। পাশাপাশি এই শহরে রয়েছে প্রাচীন রাম ঘাট। কুম্ভ মেলা উপলক্ষে প্রতি ১২ বছর অন্তর এই ঘাটে বিপুল জনসমাগম ঘটে।
কিন্তু কেন এত প্রাধান্য পায় মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ? বিবিধ পুরাণ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে এই জ্যোতির্লিঙ্গের মহিমার বর্ণনা রয়েছে। চতুর্থ শতাব্দীতে কালিদাস রচিত ‘মেঘদূতম’-সহ বহু প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে।
মহাকালেশ্বর মন্দিরের শিবলিঙ্গই একমাত্র জ্যোর্তিলিঙ্গ, যার মুখ দক্ষিণ দিকে। বাকি এগারোটি জ্যোতির্লিঙ্গই পূর্বমুখী। সেই কারণে এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ ‘দক্ষিণমুখী’ নামেও পরিচিত। শিবলিঙ্গের এই বিশেষ দিকে মুখ করে থাকা শৈবতান্ত্রিক ঐতিহ্যে কিছু গূঢ় অর্থ বহন করে বলে অনেকে মনে করেন।
আবার স্থানীয় লোকবিশ্বাস, উজ্জয়িনীতে একদা চন্দ্রসেন নামে এক শিবভক্ত রাজা ছিলেন। চন্দ্রসেনের ভক্তি এবং নিষ্ঠার জোরে শিব নাকি মহাকাল রূপে আবির্ভূত হয়ে রাজার যাবতীয় শত্রু ধ্বংস করেছিলেন। এর পর তাঁর ভক্তের অনুরোধে শিব উজ্জয়িনী শহরেই অধিষ্ঠান করতে রাজি হন এবং শহরের প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন বলেও লোকমুখে প্রচলিত আছে।
উজ্জয়িনী শহর পরিচিত ‘ভারতের গ্রিনউইচ’ নামে পরিচিত। আর্যভট্টের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ অনুযায়ী, উজ্জয়িনী ভৌগোলিক ভাবে এমন একটি স্থানে রয়েছে যেখানে অক্ষরেখা এবং কর্কটক্রান্তি রেখা মিলিত হয়েছে। উজ্জয়িনীর এই বিশেষ স্থানে অবস্থানের পিছনে শিবমাহাত্ম্য আছে বলেও অনেকে মনে করেন।
মহাকালেশ্বর মন্দির কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার কোনও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য নেই। অনেকের মতে, এই মন্দির প্রাগৈতিহাসিক। আবার পুরাণমতে, প্রজাপিতা ব্রহ্মা এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। মহাকালেশ্বর মন্দিরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে, মন্দিরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কুমারসেন নামে একজন রাজপুত্রকে রাজা চণ্ডপ্রদ্যোত নিয়োগ করেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
মহাকাল মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ ‘ভস্ম আরতি’। অনেক পুণ্যার্থী কেবল এই আরতি দেখার জন্যই অনেক দূর থেকে এই মন্দিরে আসেন। প্রতিদিন ভোর ৪টেয় আরতি শুরু হয় এবং যে কেউ এতে অংশ নিতে পারেন। ভস্ম আরতির আগে শিবলিঙ্গে দই, মধু, চন্দন মাখানো হয় এবং পরে দুধ-জল ঢেলে স্নান করানো হয়।
মধ্যপ্রদেশের পর্যটন বিভাগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, অতীতে আরতির আগের রাতের প্রথম চিতা থেকে ছাই নিয়ে ভস্ম আরতি করা হত। কিন্তু এখন এই প্রথা পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে গোবর থেকে ছাই তৈরি করে ভস্ম আরতি করা হয়।
মঙ্গলবার কার্তিক মেলা ময়দানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে মোদী বলেন, ‘‘ভারতের আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রে রয়েছে উজ্জয়িনী। এর প্রতিটি প্রান্তেই ইতিহাস ছড়িয়ে রয়েছে। বহু শতকের আধ্যাত্মিকতার (কেন্দ্রস্থল) এখন সংস্কার করা হচ্ছে।’’ মোদীর দাবি, কাশী বিশ্বনাথ করিডরের থেকেও আকারে ৪ গুণ বড় মহাকাল করিডর।
মহাকালেশ্বর মন্দির করিডর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম পর্বের আওতায় প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি করিডর গড়ে তোলা হয়েছে। যাতে রয়েছে শিবের আনন্দ তাণ্ডব রূপের একশো আটটি কারুকাজ করা স্তম্ভ। এ ছাড়া, শিব এবং শক্তির দু’শোটি মূর্তি এবং ম্যুরাল রয়েছে। মূল ফটক থেকে মন্দিরের মাঝে বসানো হয়েছে আরও তিরানব্বইটি শিবের মূর্তি। এই মন্দির ঘিরে পর্যটনের প্রসারেরও যাবতীয় আয়োজন করা হয়েছে। রয়েছে বহুতল পার্কিং লট থেকে দোকানপাট, পার্ক, বৈদ্যুতিন গাড়ি-সহ নানা আধুনিক বন্দোবস্ত।