অম্বুবাচী চলাকালীন ঢেকে দিতে হয় মাতৃ শক্তির মুখ
তন্ত্রপীঠ কামাখ্যা। একাধিক রহস্যে ঘেরা পূর্বভারতের এই মন্দির। অনেকেই মনে করেন, এখানে গুপ্ত সাধনায় রত হন তান্ত্রিকরা। তন্ত্রবিদ্যার অনুশীলনে নিজেদের আরও পারদর্শী করে তোলেন তাঁরা। কথিত আছে, এই মন্দির জাদুবিদ্যা, মোহিনীবিদ্যা, ডাকিনীবিদ্যা সহ একাধিক গুপ্তসাধনার পীঠস্থান। আর সেই তন্ত্রপীঠের বার্ষিক উদযাপন হয় অম্বুবাচীর উৎসবে।বছরের নির্দিষ্ট তিনদিন। মূলত আষাঢ় মাসেই পালিত হয় অম্বুবাচী ব্রত। শাস্ত্রমতে দেবীর ঋতুকালিন অবস্থা। তাই এইসময় যে কোনও মাতৃমন্দির তিনদিন বন্ধ থাকে। মুখ ঢেকে দেওয়া হয় দেবীর মুখ। পঞ্জিকামতে বিশেষ সময় অম্বুবাচী শুরু হয়, আবার তিনদিন পর নির্দিষ্ট সময় তা শেষ হয়।
ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমির বিভিন্ন স্থানে ৫১ টি শক্তিপীঠ অবস্থিত, যাদের দর্শন ও পুজো করলে বিভিন্ন মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। এমনই একটি শক্তিপীঠ রয়েছে যাকে বলা হয় মহাশক্তিপীঠ। এই মন্দিরটি আসাম রাজ্যের গুয়াহাটির একটি পাহাড়ে নির্মিত। এই মন্দিরটি অন্যান্য শক্তিপীঠ থেকে কিছুটা আলাদা কারণ এই স্থানটি তন্ত্র সাধনার জন্যও খুব বিখ্যাত।
এই মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই, এখানে মা সতীর যোনি অংশ পতিত হয়েছিল, তাই এখানে দেবীর যোনি অংশটিই পূজিত হয়, যা পাথরের আকারে উপবিষ্ট। যারা এই শিলাকে পুজো করেন, দেখেন এবং স্পর্শ করেন, তারা দেবীর কৃপা ও মোক্ষে মা ভগবতীর সঙ্গ লাভ করেন। এই শক্তিপীঠে, মাতৃদেবী ৬৪ টি যোগিনী এবং দশটি মহাবিদ্যার সঙ্গে বিরাজমান। ভুবনেশ্বরী, বগলা, ছিন্নমস্তা, কালী, তারা, মাতঙ্গী, কমলা, সরস্বতী, ধূমাবতী এবং ভৈরবী একই স্থানে উপবিষ্ট। যদিও সমস্ত শক্তিপীঠের নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু কামাখ্যা শক্তিপীঠকে অন্য সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়।
অম্বুবাচী উৎসব কী: অম্বুবাচী শব্দটি অম্বু এবং বাচী এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত যার অম্বু অর্থ জল এবং বাচী অর্থ বসন্ত। এই শব্দটি নারীর শক্তি এবং তাদের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে। প্রতি বছর জুন মাসে মা কামাখ্যার মন্দিরে এই মেলা বসে। অম্বুবাচী উৎসবের সময় মা ভগবতীর গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকে এবং দর্শনও নিষিদ্ধ এই সময়। তিন দিন পর মা ভগবতীর রজস্বলা শেষে তার বিশেষ পুজো ও ধ্যান করা হয়। চতুর্থ দিনে ব্রহ্ম মুহূর্তে দেবীকে স্নান করানোর পরই মন্দির খুলে দেওয়া হয় ভক্তদের দর্শনের জন্য।
যাত্রীরা প্রথম দিনে কামেশ্বরী দেবী এবং কামেশ্বর শিবের দর্শন করেন এবং তারপরে মহামুদ্রায় যান। দেবীর যোনিমুদ্রাপীঠ দশ ধাপ নিচে একটি গুহায় অবস্থিত যেখানে অখণ্ড প্রদীপ সর্বদা জ্বলে। এখানে আসা-যাওয়ার জন্য আলাদা পথ রয়েছে, এখানে প্রসাদ আকারে ভক্তদের একটি ভেজা কাপড় দেওয়া হয়, যাকে বলা হয় অম্বুবাচী বস্ত্র। কথিত আছে, দেবীর ঋতুস্রাব হওয়ার আগে গর্ভগৃহে অবস্থিত মহামুদ্রার চারপাশে সাদা কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়, তিন দিন পর মন্দিরের দরজা খুললে এই কাপড়গুলো মায়ের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। পরে এই কাপড় প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
শুধু তাই নয়, এই বিশেষ সময় লাল হয়ে যায় ব্রহ্মপুত্র নদীর জলও। আজ অবধি যার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি কেউ। করলেও তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। মনে করা হয়, দেবী ঋতুকালের প্রভাবেই এই বিশেষ পরিবর্তন হয়। এখানেই শেষ নয়। অম্বুবাচীর সময় নাকি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় মন্দিরের দরজা। তিনদিন পর সেই দরজা খোলে। এইসময় ভক্তদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ উৎসবের আবহে সেজে ওঠে কামাখ্যা মন্দির চত্বর।