আগের দিনের মাটন কষা এত সুস্বাদু কেন?
রাত ১২টা। ফ্রিজ খুলে বেরোল এক বাটি আগের দিনের মাটন বিরিয়ানি বা এক বাটি পায়েস, আরও খুঁজে কিছু তালের বড়াও বেরল। ঠান্ডা ঠান্ডা খেতে গিয়েও যেন এক গাল হাসি এসে গেল মুখে - এতটা ভাল লাগল কেন? কেমন যেন সদ্য ধোঁয়া ওঠা খাবারের থেকেও একটু বেশি ‘ইয়াম’।
এটা শুধু খিদে পেয়েছে বলে নয়, বা নস্টালজিয়া কাজ করছে এমনও নয়। বাস্তব হল, ভারতীয় খাবার পরের দিন আরও বেশি সুস্বাদু হয়ে ওঠে। এ শুধুই রান্নাঘরের ম্যাজিক নয়, এর পেছনে রয়েছে খাঁটি রসায়ন আর রান্নার গুণ।
মশলার প্রতি প্রেম ও ধৈর্য-ই রসায়ন
যখন আপনি কোনও কারি রান্না করেন, তখন হলুদ, ধনে, জিরে, লঙ্কাগুঁড়ো, গরম মশলা দিলেন, কষিয়ে রান্নাও করলেন। কিন্তু আসল ব্যাপার এটাই যে, রান্নার সময় সব ফ্লেভার একসঙ্গে মিশে ওঠে না, কারণ সময় কম। কিন্তু যখন সেটাই ফ্রিজে রাখা হয়, তখনও এই মশলার ফ্লেভার আস্তে আস্তে মজতে থাকে। তেল বা ঘিয়ের ফ্যাট তাদের সুগন্ধিকে ধরে রাখে, আর ডাল, মাংস বা সবজি ধীরে ধীরে সেই স্বাদ নিজের মধ্যে টেনে নেয়।
এটাই হল "ফ্লেভার মেল্ডিং" — মশলার স্বাদ তখনই চূড়ান্ত হয়ে ওঠে, যখন আপনি তাকে একটু ‘বিশ্রাম’ দেন। যে কারণে অনেকে রান্নার একদম শেষে আঁচ থেকে নামিয়ে চাপা দিয়ে কিছুক্ষণ মজতে দেন, ওই মিনিট দুই তিনেই লুকিয়ে থাকে স্বাদের আসল রহস্য।
বিরিয়ানি: এক রাতের অপেক্ষায় রাজকীয়তা
বিরিয়ানি প্রেমীরা জানেন যেদিন রান্না হয়, সেদিনও ভাল লাগে, কিন্তু দ্বিতীয় দিন বিরিয়ানি স্বাদে গন্ধে একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়। কারণটা কী?
দমে রান্না হলেও অনেক সুগন্ধি উপাদান তখনও পুরোপুরি মিশে ওঠে না। এক রাত বিশ্রাম নেওয়ার পর কেশর, এলাচ, ভাজা পেঁয়াজ থেকে শুরু করে চাল আর মাংস - সব একেবারে নিখুঁতভাবে জুড়ে যায়। ফ্যাট একটু একটু করে চালের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সবটা হয়ে ওঠে যেন ‘কালিনারি ভেলভেট’ - নরম, গভীর, অভিজাত।
ডাল বা পায়েস: ধীরে ধীরে জমে ওঠা স্বাদ
ডাল জাতীয় খাবার নিজেই একটু স্পঞ্জের মতো, মশলা টেনে নেয়। টমেটো-পেঁয়াজের গ্রেভি হলে তা পরদিন আরও ঘন হয়, রঙ গাঢ় হয়, আর স্বাদ হয় অনেক বেশি গভীর। শুধু জিরে, রাঁধুনির ফোড়নেও তাঁর তুলনা নেই।
তেলের রহস্য: ফ্লেভার ধরে রাখা সংরক্ষক
ভারতীয় রান্নায় তেল শুধু একটা মাধ্যম নয়, সেটা একটা টাইম ক্যাপসুল। মশলা তেলে ফুটে ওঠে, আর সেই তেল গোটা রান্নাকে ঢেকে রাখে। ফ্রিজে রাখলে সেই তেল ওপরে উঠে যায়, আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রান্নায় নতুন করে ফ্লেভার ছড়িয়ে পড়ে। গরম করলেই যেন আবার প্রাণ ফিরে পায় সেই তরকারিতে।
ভারতীয় রান্নায় ঠাকুমা-দিদিমারা একেকজন ঘরোয়া বিজ্ঞানী। তাঁরা আগেই জানতেন, কোনও কোনও রান্না আগে করে রাখলে স্বাদ আরও ভাল হয়। তাই তো বিয়েবাড়ি, পুজো বা কোনও অনুষ্ঠানে এখনও অনেক বাড়িতেই আগের দিন রাতে রান্না সেরে রাখা হয়।
বাঙালির মাছের ঝোল, বা তামিলনাড়ুর সাম্বার, পরদিন খেলে হয় একেবারে তুলনাহীন। কোরমা-র মতো ঘন গ্রেভিও রান্নার পর একটু বসে থাকলে আরও ঘন, আরও সুস্বাদু হয়।
এই ‘দিন-দুই পরে খাওয়ার’ সংস্কৃতি আমাদের শেখায় ধৈর্যের মিষ্টি ফল কেমন হয়।
আগেরদিনের খাবার থেকে সর্বোচ্চ স্বাদ পেতে কী করবেন:
• স্টিল বা সেরামিক পাত্রে রাখুন। প্লাস্টকের পাত্র খাবারের ফ্লেভার বদলে দিতে পারে।
• জল মিশিয়ে গরম করবেন না। জল ফ্লেভার হালকা করে দেয়।
• হালকা আঁচে গরম করুন। মাইক্রোওয়েভ নয়, ফ্লেমে গরম করুন।
• ফ্রেশ কিছু উপাদান যোগ করতে পারেন যেমন একটু ধনেপাতা, লেবুর রস বা কাঁচা পেঁয়াজ।
আগের দিনের রান্না মানেই কিন্তু ‘বেঁচে যাওয়া খাবার’ নয়, ওটা ‘ফ্লেভার-এজড ট্রেজার’। ওতে মিশে থাকে সময় ও মশলার জাদু আর সঙ্গে রান্নার ধৈর্য।