চন্দননগরের আলোকযাত্রায় মুগ্ধ বিশ্ব
উৎসবের মরশুম এলেই শহর-বহর আলোর চাদরে ঢেকে যায়। দুর্গাপুজো- কালীপুজোর পর উৎসবের আনন্দ ধরে রাখে জগদ্ধাত্রী পুজো। আর এই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রসঙ্গ উঠলে যে জায়গার নাম ভেসে ওঠে, তা হল চন্দননগর (Jagaddhatri Puja lights)। বিভিন্ন মণ্ডপের মাতৃপ্রতিমার রূপ যেমন মুগ্ধ করে তেমনই এখানকার আলোকসজ্জা (Chandannagar light festival)। পুরো শহরই রাতে আলোর মালায় সেজে ওঠে, সেই দারুণ দৃশ্য দেখলে মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে। আজকের চন্দননগরের আলোর ঝলক কার্যত জগৎ বিখ্যাত, কিন্তু তার পেছনে লুকানো আছে শত বছরের গল্প আর বহু মানুষের পরিশ্রম, যা অনেকেরই অজানা।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা প্রায় আঠেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু। ১৮৫৪ সালে রেলপথ চালু হওয়ার পর বাংলার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে পুজো দেখতে আসে। শোভাযাত্রার ভিড় বাড়তে থাকে, মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ে- কিন্তু তখনকার সময়ে বৈদ্যুতিক আলো ছিল না। নিরঞ্জনের সময় অল্প আলোতে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে। এরপরই আলোর প্রয়োজন বোধ করেন সাধারণ মানুষরাই। প্রথমে পিতলের বড় গামলায় ঘুঁটে জ্বেলে প্রতিমার সামনে সারিবদ্ধভাবে রাখা হত। পরে বাঁশের মাথায় কাপড় দিয়ে কেরোসিন ভিজিয়ে মশাল তৈরি করা হয়, যদিও সেটিও বেশিদিন জ্বলত না। পরবর্তীতে হ্যাজাক নামে আরও উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করা শুরু হয়, যা বহু দূর-দূরান্ত থেকে আনা হত।
চন্দননগরে বিদ্যুৎ সংযোগ আসে ১৯৩৪ সালে, চার বছর পরই মণ্ডপে বৈদ্যুতিক আলো বসানো শুরু হয়। স্বাধীনতার পরে, ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় টিউবলাইট ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে আলো ও প্রযুক্তি ক্রমে বদলে গেছে- বড় টুনি বাল্ব থেকে ছোট ৬.২ টুনি বাল্ব, তারপর এলইডি। ১৯৮৮ সালে এলইডি চন্দননগরের আলোকসজ্জায় আসে, পরে শিল্পী বাবু পাল এলইডির উপর ক্যাপ করে আলোর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন। আজ এখানে থ্রি ডি, অ্যানিমেশন-সহ নানা ধরনের লাইটিং ব্যবহার হয় (LED lighting Chandannagar)।
চন্দননগরের আলোর খ্যাতির পেছনে আছেন বহু আলোকশিল্পী, তাঁরা হলেন- শ্রীধর দাস, তারক শেঠ, বাবু পাল, অসীম দে প্রমুখ। বিশেষ করে শ্রীধর দাসের হাতে তৈরি আলোককর্ম সমগ্র দেশে এবং বিদেশেও প্রশংসিত হয়- মস্কো, লন্ডন, আমেরিকা, এমনকি আইফেল টাওয়ারের মতো জায়গায় তাঁর হাতের কাজ পৌঁছে গেছে। এখন চন্দননগরের আলোকসজ্জা শুধু একটি ছোট শিল্প নয়, এটি একটি পরিকল্পনা, লোহা বা ফাইবারের কাঠামো, থ্রিডি ডিজাইন ও অর্থোমাত্রায় পরিণত হয়েছে।