বিশ্বের প্রথম সাদা বাঘ
বাঘ শুধু বন্যপ্রাণী নয়, সে কখনও ইতিহাস, কখনও ঐতিহ্য, কখনও রাজকীয়তার প্রতীক। তেমনই এক কিংবদন্তির নাম ‘মোহন’, বিশ্বের প্রথম সাদা বাঘ (First White Tiger), যার শুরুটা হয়েছিল মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh) রেওয়া থেকে।
১৯৫১ সাল। রেওয়ার সিধি জেলার বারগদি জঙ্গলে হঠাৎ চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দর্শনের বাঘ। শরীর সাদা, চোখ নীল। রেওয়ার মহারাজা মার্তান্ড সিং সেই মুহূর্তে বুঝেছিলেন, এ বাঘ সাধারণ নয়। দ্রুত তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় গোবিন্দগড় রাজপ্রাসাদে। সেই থেকেই শুরু মোহনের রাজপথে যাত্রা।
রাজপরিবারের চোখে মোহন ছিল আর পাঁচটা পশু নয়, বরং বংশের এক রাজপুত্র। প্রাসাদে সকলেই তাকে ডাকত ‘মোহন সিং’। চামচে করে দুধ খাওয়া, রাজকীয় পদের মানুষদের মতো যত্ন- মোহনের ছিল নিজস্ব ঘর, সিংহাসন আর সুনিশ্চিত সম্মান।
আর তার ছিল এক আজব অভ্যাস, রবিবারে উপবাস (Fasted))! রাজা চাইলেও ওই দিন কিছুতেই কিছু খেত না মোহন। দুধ ছাড়া কিছু ছোঁয়ও না। শুধু গম্ভীর নয়, ছিল তার খেলোয়াড় মনও। প্রাসাদের উঠোনে সে নাকি ফুটবল (played football) খেলত মনের আনন্দে।
সময় গড়ায়। মোহনের জীবনেও আসে সঙ্গিনী—তিনটি বাঘিনী। এর মধ্যে রাধা-র গর্ভে জন্ম নেয় ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত জন্মানো চার সাদা বাঘশাবক—রাজা, রানি, মোহিনী ও সাকেশি। শুরু হয় এক রাজবংশের বিস্তার। মোহনের থেকে জন্মায় মোট ৩৪টি বাঘশাবক, যার মধ্যে ২১টিই ছিল সাদা।
এই বাঘশাবকেরা দেশের নানা চিড়িয়াখানা ও বিদেশে পৌঁছে দেয় মোহনের রক্ত। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, রেওয়া থেকে একসময় হারিয়ে যায় সাদা বাঘের অস্তিত্ব। ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর, মোহনের মৃত্যু হয়। তাকে গোবিন্দগড় দুর্গে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়। এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ।
শেষ নিঃশ্বাস ফেলে মোহনের শেষ বংশধর 'বীরাট' ১৯৭৬ সালে। থেমে যায় রেওয়া-র সাদা বাঘ অধ্যায়। তবে আশার আলো জ্বলে ২০১৬ সালে, রাজ্যের মন্ত্রী রাজেন্দ্র শুক্ল-র চেষ্টায়। গড়ে ওঠে মুকুন্দপুর হোয়াইট টাইগার সাফারি। ‘বিন্দ্যা’ নামে এক সাদা বাঘিনী আনা হয়—রেওয়া-র সেই গর্ব ফিরে পায় নতুন চেহারায়।
তবে ইতিহাসবিদরা মনে করিয়ে দেন, সাদা বাঘের উপস্থিতি ভারতে মোহনেরও আগে। আকবরনামা-য় বর্ণিত, ১৫৬১ সালে সম্রাট আকবর নিজ হাতে শিকার করেছিলেন দু’টি সাদা বাঘ। তবুও ইতিহাসের আসল নায়ক হয়ে উঠেছে মোহন—কারণ সে শুধু বাঘ নয়, একটা সময়ের প্রতিচ্ছবি, রাজকীয়তার জীবন্ত কাহিনি, ভারতের বন্যপ্রাণ ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।