হাতি মেরা সাথি, গজরাজের মল ‘অমূল্য রতন
অতিকায় প্রাণী হাতির সঙ্গে খুবই প্রাচীন যুগ থেকে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে ক্ষুদ্র মানুষের। গজরাজের দল বিভিন্নভাবে মানবসভ্যতা গড়ে তোলার কাজে এসেছে। কিন্তু, অনেকেই জানেন না, গোবরের মতোই হাতি মলত্যাগ করেও মানুষের উপকারে লাগে। অনেকেই মনে করেন, হাতির নাদা (মল) আবার কী কাজে লাগে! কিন্তু এটা হল প্রাকৃতিক সম্পদ, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। আর সে কারণেই হাতির মল বিক্রি হয় চড়া দামে। পরিবেশবান্ধব কাগজ তৈরি থেকে চমক ধরানো পানীয় এবং প্রাকৃতিক কীটনাশক এমনকী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর বাইরে হাতির মল ক্ষুদ্রাণু প্রাণের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে। বহু পোকামাকড়ের খাবার এবং মলে থাকা অপাচ্য বীজ বহু দূরে রোপণের কাজ করে হাতির মল।
কাগজ তৈরি
পরিবেশবান্ধব কাগজ তৈরিতে অতি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হল হাতির মল। কারণ, এই প্রাণী যা খায়, তার মাত্র অর্ধেকাংশ হজম করে। ফলে হাতির মলে থাকে অপাচ্য বহু রকমের ঘাসপাতার ফাইবার। সেকারণে এই ফাইবার থাকায় হাতে তৈরি কাগজ প্রস্তুতে কাজে লাগে। খুব ভাল করে মল ধুয়ে এই ফাইবার কয়েক ঘণ্টা ধরে জলে ফুটিয়ে নরম করে নিয়ে তা পিটিয়ে নরম দলায় মণ্ডে পরিণত করা হয়। এবং সেটা বেলে নিলে তা কাগজের আকার নেয়। এই কাগজ দিয়েই খাতা, গিফট কার্ড, খাম এবং শিল্পীর ছোঁয়ায় শিল্পকর্মে পরিণত হয়।
বিশেষ পানীয় এবং অভিনব পানীয় প্রস্তুত
এই অস্বাভাবিক কাঁচামালের সাহায্যে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের পানীয় প্রস্তুত হয়। সকলেই জানেন, লাক্সারি কফি উৎপাদন হয় থাইল্যান্ডে। যেখানে কফি বীজের ফল খাওয়ানো হয় হাতিকে। যা পরে মল থেকে বেছে বেছে সংগ্রহ করা হয়। এতে বিনে ফ্রুটি, চকোলেটের মতো সুগন্ধ আসে কফি বিনে। যা দিয়ে বিরল এবং খুবই দামি কফি তৈরি করা হয় এবং পর্যটকদের কাছে এর চাহিদাও প্রচুর।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইন্দলোভু জিনেরও কাঁচা রসদ মেলে হাতির মল থেকে। মলকে ধুয়ে, স্যানিটাইজ করে, শুকিয়ে অপাচ্য উদ্ভিজ্যকে জিনে মেশানো হয়। এতে জিনে একটি মেটেমেটে, ঘাস ঘাস স্বাদ-গন্ধ আসে। জাপানেও একটি বিয়ার প্রস্তুত হয় যা হাতির মল থেকে সংগ্রহ করা কফি বিন দিয়ে বানানো হয়। এটিও বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছে।
কীটনাশক
বহু গ্রামীণ এলাকায় শুকনো হাতির মলকে কীটনাশক হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। একে জ্বালিয়ে দিলে ঘন ধোঁয়া নির্গত হয় যা মশামাছি দূর করে। সাফারি গাইডরা এই পদ্ধতি হামেশাই ব্যবহার করেন জঙ্গল ভ্রমণের সময়।
জরুরিকালীন জলের ঘাটতি মেটায়
প্রচণ্ড অস্তিত্ব রক্ষার সময়ে হাতির মল হল জলের শেষ উৎস। কারণ হাতির খাদ্যই হল জলে ঠাসা ঘাসপাতা। তাজা মলে তাই প্রচুর পরিমাণে জল থাকে। জীবনরক্ষার বিশেষজ্ঞদের মতে, তাজা মল চিপে নিলে কয়েক ফোঁটা তরল বেরয়। যা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ডিহাইড্রেশন রুখতে সক্ষম। কারণ এতে খুবই কম পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে হাতির মল জীবনরক্ষা করতে পারে।
পরম্পরাগত ওষুধ
হাতি যেহেতু বুনো গাছগাছড়া খায়, তাই তার মলেও থাকে বেশ কিছু জড়িবুটি। এই সব আয়ুর্বেদিক গাছগাছড়ার নির্যাস থাকে। হাতির শুকনো মলের ধোঁয়া মাথাব্যথা, দাঁতের ব্যথা এবং সাইনাস দূর করতে পারে গ্রামের লোকের বিশ্বাস। কিছু ক্ষেত্রে নাক থেকে রক্তক্ষরণের ব্যবহার করা হয়।
প্রাকৃতিক সার
কৃষকরা হাতির মলকে সার হিসেবে জমিতে দিয়ে থাকেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এর হাইফাইবার মাটির গঠন ঠিক রাখে। মলে থাকা ঘাসপাতা মাটিতে মিশে কম্পোস্ট সারে পরিণত হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি হয় হাতির মল দিয়ে। যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে জৈব বিদ্যুৎ। বায়ো গ্যাস দিয়ে রান্না, বিদ্যুৎ তৈরি করা হচ্ছে। বাকি অংশ কাজে লাগে জৈব সার প্রস্তুতে। মানুষের কাজে লাগার বাইরেও হাতির মল প্রকৃতির অন্যান্য পোকামাকড়, কীটাণুদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। পাখি, মৌমাছিদের মুখে মুখে হাতির মলে থাকা বীজ প্রাকৃতিক অরণ্য গঠনে সহায়ক ভূমিকা নেয়।